রোহিঙ্গারা তিন কারণে মিয়ানমার ছাড়ছে

0
1128

From Prothom-alo.com: আব্দুল কুদ্দুস ও গিয়াস উদ্দিন টেকনাফ সীমান্ত থেকে | আপডেট: ০১:৪৮, নভেম্বর ২৮, ২০১৬

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য (সাবেক আরাকান রাজ্য) থেকে গত এক মাসে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় অনুপ্রবেশ করেছে প্রায় নয় হাজার রোহিঙ্গা। তারা আশ্রয় নিয়েছে মূলত টেকনাফের লেদা ও উখিয়ার কুতুপালংয়ে দুটি অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে।

এই দুই শিবিরে আগে থেকেই আছে অন্তত দুই লাখ রোহিঙ্গা। শিবিরের বাইরে সরকারি বনজঙ্গল নিধন, উপকূলে মাছ শিকার, চিংড়িপোনা আহরণ এবং দিনমজুরি করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করে রোহিঙ্গারা। এরপরও দেশত্যাগ করে ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে। সম্প্রতি অনুপ্রবেশ করে ওই দুই শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গতকাল রোববার আলাপকালে জানা গেছে, প্রধানত তিন কারণে তারা দেশ ছেড়েছে। এগুলো হলো রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের আয়রোজগার বন্ধ ও অভাব-অনটন, দমন-পীড়ন এবং ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ।

দেশ ত্যাগ করে গতকাল ভোরে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে লেদা ক্যাম্পে এসেছেন রোহিঙ্গা নারী সলেমা খাতুন (৩৫)। তাঁর বাড়ি রাখাইনের পোয়াংখালী গ্রামে। গত শনিবার রাতে নাফ নদী পেরিয়ে
তাঁরা প্রথমে টেকনাফের মুছনী গ্রামে ওঠেন। পরে গাড়িতে করে এসে এই শিবিরে আশ্রয় নেন।

অনুপ্রবেশের কারণ জানতে চাইলে সলেমা খাতুন বলেন, ১২ দিন ধরে স্বামী (কেফায়ত উল্লাহ) নিখোঁজ। আয়রোজগারের কেউ নেই। এ ছাড়া মগ সেনারা রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে। ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ভিটাছাড়া করছে। রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে। মেয়েদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ করছে। তাই বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।

রশিদ উল্লাহ (২০) নামের এক রোহিঙ্গা বলেন, সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য পালিয়ে টেকনাফ এসেছেন।

কুতুপালং শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মরিয়ম বেগম (২৩) বলেন, ১৮ নভেম্বর মগ সেনারা তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। শোনা গেছে, তাঁকেও হত্যা করা হয়েছে। কোনো উপায় না দেখে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। তাঁর বাড়িও পোয়াংখালী।

কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের পরিচালক আবু ছিদ্দিক বলেন, গত ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যে তিনটি পুলিশ ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ৩০ জন নিহত হয়। এরপর থেকে রাখাইনে ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের’ নামে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করেছে সেনা ও পুলিশ। গত এক মাসে এই ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত সাত হাজার রোহিঙ্গা। এর মধ্যে অন্তত পাঁচ হাজার নারী ও শিশু। নারীদের মধ্যে অনেকে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার। অনেকে স্বামী ও সন্তানদের হারিয়েছে। বেশির ভাগ রোহিঙ্গা এসেছে ভিটাবাড়ি হারিয়ে। মগ সেনারা রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে হত্যা, ধর্ষণ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছে; যাতে রোহিঙ্গারা দেশত্যাগে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি টেকনাফ ও উখিয়ায় নয় হাজারের মতো রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এদের বেশির ভাগ এসেছে অভাব-অনটনের শিকার হয়ে। কারণ, রাখাইনে রোহিঙ্গা পুরুষদের কাজকর্ম নেই। পুরুষদের বাধ্যতামূলকভাবে বিনা টাকায় সেনা ব্যারাকের উন্নয়নমূলক কাজে খাটানো হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলারও কেউ নেই।

সম্প্রতি নাফ নদীর ঘুমধুম ও বালুখালী সীমান্ত অতিক্রম করে উখিয়ায় অনুপ্রবেশের সময় বিজিবি ৪১৬ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তের ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাখাইনে সেনা-পুলিশ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। এ কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। অনুপ্রবেশের সময় বিজিবি রোহিঙ্গাদের আটক করে ফেরত পাঠাচ্ছে। তবে বেশির ভাগ রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ রোহিঙ্গা পরিবার আসছে অভাব-অনটনের কারণে। কেউ আসছে চিকিৎসার জন্য। অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে কিংবা বসতভিটা হারিয়েও আসছে অনেকে। তাদের মানবিক সহযোগিতা দিয়েই মিয়ানমারে ফেরত পাঠাচ্ছে বিজিবি।

টেকনাফ স্থলবন্দরে মাছ নিয়ে আসা মিয়ানমারের একজন ব্যবসায়ী বলেন, রাখাইনের মংডু শহরে অধিকাংশ দোকানপাট রোহিঙ্গাদের। মংডুর আশপাশে অন্তত ১০-১২টি গ্রাম রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত। সেখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বসবাস করে মগ সম্প্রদায়ের লোকজন। ৯ অক্টোবর পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ঘটনার পর মগরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি ও সম্পদ দখলে নিচ্ছে। এতে রোহিঙ্গারা বেকায়দায় পড়ে। রোহিঙ্গা পুরুষেরা ঘরবাড়ি ও সম্পদ ফিরে পাওয়ার আশায় রাখাইনে আছে। কিছু রোহিঙ্গা পুরুষ সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গা পুরুষেরা স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নিরাপদে রাখতে বাংলাদেশ ঠেলে দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, টেকনাফ ও উখিয়ার দুটি (নয়াপাড়া ও কুতুপালং) শিবিরে দেড় যুগ ধরে রয়েছে নিবন্ধিত প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। শিবিরের বাইরে আশপাশের পাহাড়-জঙ্গল দখল করে বাস করছে আরও অন্তত পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের ৮০ শতাংশ এসেছে অভাব-অনটনের কারণে। পুরুষদের কেউ কেউ স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের ক্যাম্পে রেখে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও রয়েছে লাখো রোহিঙ্গা। তাদের একটি অংশ বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সেখানে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। রোহিঙ্গা সমস্যা দেশে সংকট তৈরি করছে।

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চলছে: স্থানীয় সূত্র বলেছে, টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তের ১২টির বেশি স্থান দিয়ে গতকাল ভোরে প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। অনুপ্রবেশের চেষ্টায় নাফ নদীতে ২০টির বেশি নৌকায় ভাসছে আরও অন্তত ৫০০ রোহিঙ্গা।

অনুপ্রবেশকারী কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেন, গত শুক্রবার রাতে রাখাইনের বলিবাজার ও হাতিপাড়ায় সেনাবাহিনীর বিশেষ অভিযানে ৪০টির বেশি রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। গুলিতে নিহত হয়েছে ৩০ জনের বেশি। ওই ঘটনার পর এই দুই গ্রামের কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশায় সীমান্তে জড়ো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, শনিবার রাতে উখিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় বিজিবি একটি নৌকাসহ পাঁচজন রোহিঙ্গাকে প্রতিরোধ করেছে। এর মধ্যে তিনজন পুরুষ ও দুটি শিশু। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে বিজিবি সতর্ক রয়েছে।

টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, শনিবার রাতে টেকনাফ সীমান্তে অনুপ্রবেশের সময় ছয়টি নৌকায় থাকা শতাধিক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here