
বর্জনীয় ও নিন্দনীয় কুপ্রবৃত্তিসমূহ হলো ষড়্রিপু। যথা: ১. কাম, ২. ক্রোধ, ৩. লোভ, ৪. মোহ, ৫. মদ, ৬. মাৎসর্য। নৈতিকতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত বিষয়গুলোর অন্যতম হলো ১. সুশাসন, ২. ন্যায়বিচার, ৩. মানবাধিকার, ৪. অহিংসা, ৫. ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, ৭. শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা।
Ethic (এথিক) অর্থ নৈতিক নীতিমালা, পদ্ধতি, জীবনবিধান। Ethics (এথিকস) অর্থ নীতিবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্রের শাখাবিশেষ, নৈতিক বল। Ethical (এথিক্যাল) অর্থ নীতিসম্পর্কিত, নৈতিক প্রশ্নসম্পর্কিত। Ethically (এথিক্যালি) অর্থাৎ নৈতিক প্রশ্নে, নীতিগতভাবে। Faith (ফেইথ) অর্থবিশ্বাস, আস্থা; প্রতিশ্রুতি, শপথ; আনুগত্য, বিশ্বস্ততা। Faithful (ফেইথফুল) অর্থ বিশ্বস্ত, অনুগত; সত্যানুগ, যথাযথ; বিশ্বাসী নরনারী। Ethic (এথিক)-এর সঙ্গে Faith (ফেইথ) সরাসরি সম্পর্কিত। কারণ, মানুষ বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত হয়, অবিশ্বাসীর
এথিক বা নৈতিকতা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক ব্যাপার; বিশ্বাসীর জন্য নৈতিকতা একান্ত জরুরি ও অপরিহার্য বিষয়।
ধর্ম ধার্মিকের পক্ষে কল্যাণকর। অধার্মিকের জন্য ধর্ম জুলুমের হাতিয়ার। ধর্মের নামেই অধার্মিকেরা বহু নবী-রাসুলকে হত্যা করেছে। ধর্মের নামেই নমরুদ হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছে। ধর্মের নামেই রাজা দাকিয়ানুসের জুলুমের শিকার হয়ে সপ্ত যুবক আসহাবে কাহাফ বা গুহাবাসী হয়েছে। ধর্মের নামেই তৎকালীন স্বার্থান্বেষী মহল হজরত ঈসা (আ.)-এর বিরোধিতা করে। ধর্মের নামেই মক্কার আবু জেহেলরা ‘আল আমিন’ (বিশ্বাসী ও সত্যবাদী)-খ্যাত হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে স্বীয় প্রিয় মাতৃভূমি থেকে হিজরত করতে বাধ্য করে।
বিশ্বভ্রাতৃত্ব অর্থ পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ঐক্য। ধর্ম এসেছে শান্তির বাণী নিয়ে। ধর্মের দৃষ্টিতে সব মানুষ পরস্পরের ভাই। কারণ, তারা সবাই একই পিতা-মাতার সন্তান। ধর্মে হিংসা-বিদ্বেষ ও হঠকারিতা নেই। ধর্ম চায় প্রেম-ভালোবাসা ও মায়া-মমতার বন্ধনে পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করা। একতাবদ্ধতা ও মিলেমিশে থাকাকে বলা হয় উখওয়াত বা ভ্রাতৃত্ব। দেশ, জাতি, অঞ্চল, ভাষা, বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষ মিলেই গড়ে ওঠে ভ্রাতৃত্ব।
ইসলাম ধর্ম সবার ক্ষেত্রে উদার। উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ইসলামি ভ্রাতৃত্ব বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উপযোগী ও অনুকূল। ইসলাম পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুলকে বিশ্বাস করে এবং সম্মানের চোখে দেখে। ইসলামি ভ্রাতৃত্বের অন্যতম লক্ষ্য হলো বিশ্বমানবতার ঐক্য। কোরআন-হাদিসে ঐক্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমার রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়ো না।’ ধর্মীয় সমাজব্যবস্থায় অনুপম ভ্রাতৃত্বের একটি বৈশিষ্ট্য হলো পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য। সাম্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বে বংশমর্যাদার পার্থক্য নেই, নেই দেশ ও ভাষার পার্থক্য।
ইসলামি দর্শনে অনুপম ভ্রাতৃত্বে আরব-অনারব, ধনী-গরিব তথা সব মানুষ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘অনারবদের ওপর আরবদের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আরবদের ওপর অনারবদের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ ভ্রাতৃত্বের প্রতিবন্ধক হলো স্বার্থপরতা।
ইসলাম সবাইকে স্নেহ-ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ রাখতে চায়। আবদ্ধ রাখতে চায় বিশ্বভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধে। ইসলাম ঘোষণা দিয়েছে, দুনিয়ার সব মানুষ এক আদমের সন্তান। অতএব, সৃষ্টিপ্রক্রিয়া অনুসারে কারও ওপর কারও প্রাধান্য নেই। আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত সে ব্যক্তি, যে সর্বাধিক পরহেজগার।
বিশ্বের সব মানুষ এক ও অভিন্ন। এক দেহ, এক প্রাণের মতোই। নবী (সা.) বলেন: মুসলমান ভাই ভাই, সে অন্যের প্রতি জুলুম করে না, তিরস্কার করে না। যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে অন্যের দুঃখকষ্ট লাঘব করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিনে তার দুঃখ দূর করবেন। যে অন্যের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ তাআলা হাশরের দিনে তার দোষ গোপন রাখবেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের মধ্যে দয়ামায়া এবং সহমর্মিতার একটি দেহের মতো। দেহের একটি অংশে ব্যথা হলে সর্বাংশে তা অনুভূত হয়। (বোখারি ও মুসলিম)।’ শেখ সাদি (রহ.) বলেন: ‘আদমসন্তান একই অঙ্গের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ, যেহেতু সে একই বস্তু হতে সৃষ্ট; অঙ্গের কোনো অংশ যদি ব্যথা পায়, অন্য অঙ্গগুলো আরাম নাহি পায়; যদি তুমি অন্যের ব্যথায় না হও ব্যথিত, মানব নাম ধারণ তোমার হবে অনুচিত। (গুলিস্তা সািদ)।
আজ সারা বিশ্বে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশা, সহিংসতা ও জিঘাংসা তা পরিহার করতে হবে। মানবজীবনকে পূর্ণ নিরাপত্তা, উন্নততর জীবন, অনাড়ম্বর ও সংযত আচরণ, আদর্শ ব্যক্তিত্ব এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও নীতিগত মান এসবের চর্চা করতে হবে।
প্রকৃত মানবজীবন গঠনের জন্য সংবেদনশীল ও বিনয়ী হতে হবে। আমরা সবাই যেন শান্তি ও মঙ্গলের পথে অগ্রসর হই। বিশ্বমানবতার জন্য কাজ করি। আমাদের মন থেকে সব ধরনের পাপ, হিংসা, বিদ্বেষ এবং সব ধরনের অমঙ্গল দূর হোক। বিশ্বমানবতা উপকৃত হোক;
বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ নয়, ধৈর্য-প্রজ্ঞা দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে এবং প্রেম–প্রীতি ও ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হবে।
বিশ্বভ্রাতৃত্বের জন্য প্রয়োজন মন্দ স্বভাব দূর করে উত্তম চরিত্র লাভ করা। মন্দ স্বভাবকে ‘রাজায়েল’ বলা হয়। রাজায়েল শব্দটি আরবি, অর্থ হলো মন্দ, নিকৃষ্ট, হীন, তুচ্ছ, ঘৃণ্য ইত্যাদি। রাজায়েল বহুবচন, এর একবচন হলো ‘রাজিল’; যা ‘রাজিলাত’ ধাতু থেকে নির্গত, এটি মূলত ‘ফাজিলাত’ (শ্রেষ্ঠ, উত্তম, ভালো)-এর বিপরীত অর্থবোধক ক্রিয়ামূল। ইসলামি পরিভাষায় রাজায়েল হলো সেই সব মন্দ স্বভাব, মন্দ আচরণ ও মন্দ কাজ, যা মানুষের সুকুমারবৃত্তির জন্য ক্ষতিকারক। সুফি পরিভাষায় রাজায়েল বলা হয় বিশেষ ১০টি মন্দ স্বভাবকে, যা তাছাওউফ ও মারেফাতের অন্তরায় বা বেলায়াতের পথে বাধাস্বরূপ। তরিকতের দৃষ্টিতে মৌলিক ১০টি রাজায়েল হলো: ১. হিরছ (লোভ), ২. তমা (লালসা), ৩. রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা), ৪. কিবর (অহংকার), ৫. কিযব (মিথ্যা), (৬) গিবত (পরনিন্দা), ৭. হাছাদ (হিংসা), ৮. উজব (অহমিকা), ৯. কিনা (পরশ্রীকাতরতা) ও ১০. বুখল (কৃপণতা)।
এসব মন্দ স্বভাবকে পরাজিত করে রিয়াজত সাধনায় ব্রতী হলেই একজন সালেক তঁার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। রাজায়েল বর্জন করতে না পারলে সায়ের ও সুলুক সম্ভবপর নয় এবং অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সুদূরপরাহত। তাই সুফি হওয়ার পূর্বশর্ত হলো রাজায়েল পরিত্যাগ করা।
মানবতা ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ও পূর্ণাঙ্গতার জন্য প্রয়োজন ফাজায়েল তথা সদ্গুণাবিল অর্জন করা। সুফি পরিভাষায় ফাজায়েল ১০টি, যথা: ১. তওবা (গুনাহের জন্য অনুতাপ করা, ক্ষমা চাওয়া)। ২. ইনাবাত (আল্লাহর দিকে মন সর্বদা রুজু করা)। ৩. জুহুদ (দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত আশা পরিত্যাগ করা)। ৪. ওয়ারা (সন্দেহজনক জিনিস থেকে বেঁচে থাকা ও সন্দেহমূলক কাজ ও খাদ্য পরিত্যাগ করা)। ৫. শোকর (কৃতজ্ঞতা বা উপকারীর উপকার স্বীকার করা)। ৬. তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হওয়া। ৭. কানাআত (অল্পে তুষ্টি)। ৮. তাছলিম (আল্লাহর হুকুম–আহকাম সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া এবং আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা)। ৯. রেজা (আল্লাহর ইচ্ছার ওপর রাজি থাকা)। ১০. ছবর (ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করা)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com